করোনাকালের করুণা খান

এই গল্পের সাথে কেউ কোন চরিত্র মিলাইবেন না। যে মিলাইবেন দায় তার… কয়া দিলাম কিন্তু….
করোনার প্রকোপে আর কিছু না হোক আমি যে পাগল হইতেছি এইটা তার বড় প্রমান। সো পাগলে কী না বলে…🧟‍♂🧟‍♂🧟‍♂🧟‍♂
Nahida Ashrafi_ by rahnuma ahmedNahida Ashrafi. Photo: Rahnuma Ahmed

করোনাকালের করুণা খান

নাহিদা আশরাফী

-আপা, শইলডা বালো?  একখান কতা ছিলো।
করুণা খান চোখ বড় বড় করে চম্পার দিকে তাকালেন, শইলডা কি চম্পা? বলেছি না ঠিক করে কথা বলবে? বলো শুভ সকাল আপা, আপনার শরীর ভালো? বলো বলো। কষ্ট হলেও সময় নিয়ে বলো। তবু শুদ্ধ বলবে। যাও চা নিয়ে এসো, আর রান্না শেষ করে আবার আমাকে শুদ্ধ করে কথাটা শোনাবে। তোমাদের নিয়ে আর পারি না।
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে উঠে এক ঘন্টা বাথটাকে বডিশপের শাওয়ার জেলে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে রেডি হয়ে নীচে নামলেন তিনি । আড়াইটায় তার ওয়ার্কারদের সাথে মিটিং ফিক্সড।যদিও তা ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে। গতকালের সিদ্ধান্ত নিয়ে দারুণ খোশমেজাজে আছেন । নিজের আপত প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ!
খাওয়া শেষ করে ডাইনিং টেবিল ক্লিয়ার করতে করতেই চা নিয়ে ঢুকলো চম্পা। কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজে থেকেই চম্পাকে কথাগুলো শুদ্ধ করে বলতে বল্লেন৷ চম্পা গলা কেশে শুদ্ধ করে বলার চেষ্টা করলো –
-আপা, আপোনার শরীলটা ভালো?
– উফ! আপোনার নয় চম্পা বলো আপনার। আর শরীলটা নয়। বলো শরীরটা৷ বলো, আবার বলো
চম্পা এই দুই লাইনেই আটকে রইলো টানা পনেরো মিনিট। তারপর খানিকটা খুশী হলেন মালকিন৷
– ওকে, এবার পরের লাইন বলো। তাড়াতাড়ি বলো। আমার আবার মিটিং আছে৷
– জ্বি আপা বলেছিলাম কি আমার পাঁচদিন ধ…ধ… ধইরা।
– উহু ধইরা নয়, বলো ধরে। হ্যাঁ বলো। পাঁচ দিন ধরে কি?
– জ্বর। গলায় বেদনা।
– আহা বেদনা না। বলো ব্যাথা।…  কী!!!
ব্যাথা শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে ভয়ংকর শীতল এক স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগলো। তিনি চিৎকার করে উঠলেন,
– তুই আগে বলিস নাই ক্যান? বেয়াদব কোথাকার।
– আপা ক্যাম্নে বলবো?  সকাল থেকে শুদ্ধ শুদ্ধ খেলায় আপ্নে আমারে যে ধমকের উপ্রে রাখছেন।
এই চম্পা তার বিছানা ঝাড়পোঁছ করেছে, রান্না করেছে, কাবার্ড থেকে শাড়ি নামিয়ে দিয়েছে, শাওয়ারের পর চুল আচঁড়ে দিয়েছে। আর এখন চা ও বানিয়েও খাইয়েছে৷ উফ!  আর ভাবতে পারে না করুণা খান। এক দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন বলে গাড়িতে ওঠেন। চেনা পরিচিত সব ডাক্তার কল করে ফেলেছেন ততক্ষণে। হল কী এই মরার দেশে। কেউ ফোন ধরে না। ভাবতে ভাবতে অফিসে ঢোকেন। কী আশ্চর্য!  কেউ নেই কেন? ফিরে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে যাবেন দেখেন ড্রাইভার নেই চম্পা ড্রাইভিং সিটে বসে দাত কেলিয়ে হাসছে। তিনি ভয়ানক আর্তচিৎকার দিয়ে গাড়ি থেকে ছিটকে  রাস্তার দিকে যান। গেটের কাছেই ড্রাইভার কাসেমের দেখা পান। কাশেম তার জন্য লাশবাহী গাড়ি এনে তাতে  উঠতে বলছে। সব কী পাগল হয়ে গেল। লাশবাহী গাড়িতে তিনি কেন উঠবেন?
তিনি দৌড়াতে শুরু করলেন,
দৌড় মিইয়ে এসে জোরে হাঁটায় রুপ নিলো।
জোরে হাঁটাও মিইয়ে এসে একসময় বসে পড়লেন।
পিছনে তাকিয়ে দেখলেন একদল মানুষ তাকে অনুসরণ করে হাটছে। হাঁটছে তো হাঁটছে… সামনে গোরস্তান, ডানে চম্পা,বায়ে কাশেম মিয়া ও তার লাশবাহী গাড়ি।
সরো, সরে যাও। দূরে যাও। আমার কাছে কেউ আসবে না বলছি। আমাকে ছোঁবে না। সাইকিক পেসেন্টের মত ভয়াবহ চিৎকার করতে লাগলেন তিনি।
– কই যাবো ম্যাডাম ? ডেকে এনে চলে যেতে বলছেন? একবার এলে আর তো যাওয়া যায় না । এটা তো একমুখী রাস্তা। তাই ঠিক করেছি সবাই একসাথে এই লাশবাহী গাড়িটাতেই থাকবো৷ ভালো হবে না ম্যাডাম?  কী বলেন?
তিনি হাতপা ছুঁড়ে মানসিক রোগীর মত চিৎকার করতে থাকেন। দিগবিদিক ছুটতে থাকেন কিন্তু বুঝতে পারেন না কোন দিকে যাবেন।
এগিয়ে আসছে চম্পা…
এগিয়ে আসছে কাশেম মিয়া…
এগিয়ে আসছে একদল পায়েচলা শ্রমিক…
আর তিনি একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন গোরস্তানের দিকে …
দূরে কোথাও কৈলাশ খেরের গান বাজছে,
’জয় জয় কারা জয় জয় কারা সোয়ামি দে না সাথ হামারা।’